শিল্পায়নে কেন পিছিয়ে উত্তরের জনপদ
শিল্পায়ন

খোরশেদ আলম:
অংশীজনেরা বলছেন, বগুড়ায় ঐতিহাসিকভাবেই শিল্পাঞ্চল। ক্রমবর্ধমানভাবে সেই ধারাতেই চলছে বগুড়া। কিন্তু উত্তরের নীলফামারির সৈয়দপুর ছাড়া অন্য কোনো এলাকায় সেভাবে আর শিল্পায়ন হয়নি। বাকীসব এলাকা বলতে গেলে পুরোটাই কৃষি নির্ভর।
যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গ্যাস সংকটের কারণে সম্ভাবনা ও অঢেল শ্রমিক থাকার পরও বগুড়ার মতো অন্য জেলায় বহুমুখী শিল্পায়ন গড়ে উঠেনি বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
বগুড়া
উন্নয়ন শিল্প খাতের খাতের জড়িত ব্যবসায়ীরা জানান, অর্থনৈতিক পরিকাঠামো আর যোগাযোগকেন্দ্রিক অবস্থানের কারণে উত্তরের ‘প্রবেশদ্বার’ বগুড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে পঠিত হয় দেশীয় অর্থনীতির মানদণ্ডের সাপেক্ষে। কালের বিবর্তনে ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা এই শহরে বণিকায়ণের অভাবনীয় এক দিগন্ত উন্মোচন হয়েছে ভৌগোলিক কারণেই। সমৃদ্ধ শিল্পায়ন, কৃষিজ যন্ত্রপাতি উৎপাদন, আকাশছোঁয়া বহুতল ভবন, নতুন নতুন সিরামিক শিল্পের অবতারণ আধুনিক বগুড়া গড়ে ওঠার স্বপ্নকে আরও বেগবান করছে।
বগুড়া তার চারপাশকে প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে যাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণেই। এই ছাড়িয়ে যাওয়া প্রভাব মেলাতে পেরেছে বগুড়ায় উৎপাদিত সেচপাম্প, রাইস ব্র্যান অয়েল, পাটজাত সুতা ও পাটের তৈরি ব্যাগ, বস্তা এবং ধানমাড়াই যন্ত্র, আলু কিংবা পোষা প্রাণী, বিভিন্ন ধরনের গাছের চারা রপ্তানির কল্যাণে। দেশে রাইস ব্র্যান্ড অয়েল উৎপাদনের জন্য ১৭ টি মিল-কারখানা গড়ে উঠেছে বগুড়ায়। এর মধ্যে বগুড়াতেই রয়েছে চারটি।
মাদার শিল্প ফাউন্ড্রি
বগুড়ার ‘মাদার শিল্প’ নামে খ্যাত ফাউন্ড্রি বা ঢালাই শিল্প। প্রায় হাজার কোটি টাকার ব্যবসার এই শিল্পে শুধুমাত্র বিসিক এলাকায় অন্তত ৪৬ টি কারখানা রয়েছে। বিসিকের বাইরে জেলার বিভিন্ন জায়গায় ছোট বড় মিলিয়ে আরও অন্তত ৩শ কারখানা গড়ে উঠেছে। ফাউন্ড্রি শিল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শ্যালো ইঞ্জিনচালিত পানির পাম্প এবং এর লায়নার, পিস্টনসহ সব ধরনের যন্ত্রাংশ, হ্যান্ড টিউবওয়েল (নলকূপ), সব ধরনের হুইল, পাওয়ার ট্রিলারের বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ, লেদ মেশিনের যন্ত্রাংশ, করাত কল (স' মিল), চিড়া তৈরির কল, অটো রাইস মিলের যন্ত্রাংশ, ফ্লাওয়ার মিলের যন্ত্রাংশ, টেক্সটাইল মিলের যন্ত্রাংশ, মোটরগাড়ির স্প্রিং, ব্রেক ড্রাম, গ্রান্ডিং মেশিন, অয়েল মিল ও জুট মিলের যন্ত্রপাতি।
এর মধ্যে পানির পাম্প ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ, ভূটান, মায়ানমারে নিয়মিত রপ্তানি হয়ে থাকে।বগুড়ার ফাউন্ড্রি কারখানাগুলোতে কৃষি ও সেচ যন্ত্রাংশই সবচেয়ে বেশি তৈরি হয়, যা দেশের মোট চাহিদার শতকরা ৭০ ভাগের জোগান দিয়ে থাকে। এসব কারখানায় সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত ১০ হাজারেরও বেশি শ্রমিকের। পরোক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছেন জেলার আরও ২৫ হাজার মানুষ।গত বছর বগুড়া থেকে প্রায় ১ কোটি টাকার সেচপাম্প রপ্তানি করা হয়েছে। বগুড়ার অর্থনীতির চাকার পূর্ণতার অবদানে এই শিল্প এককভাবেও স্বীকৃতি পেতে পারে।
বগুড়ার রেজা ইঞ্জিনিয়ার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজাউল করিম রেজা বলেন, কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে পণ্য উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। ফাউন্ড্রি শিল্পকে বাঁচাতে হলে বিদেশ থাকা আসা পণ্যের সঙ্গে দেশীয় পণ্যের ভ্যাট-ট্যাক্সের সমাঞ্জ্যতা থাকতে হবে।
সোনালী আঁশের সম্ভাবনা
বগুড়া অঞ্চলে নদী অববাহিকায় ও তুলনামূলক নিচু অঞ্চলে বেশি পাট চাষ করা হয়। কৃষি অফিস বলছে, চলতি বছরে বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে পাট চাষ হয় গড়ে ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে। এখান থেকে ৭ লাখ ৭১ হাজার ৭৪১ বেল পাট উৎপাদন হয়েছে। যা থেকে পাটজাত বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করা হয়। শুধুমাত্র বগুড়াতেই ১৮ টি জুট মিল রয়েছে। এসব মিল থেকে উৎপাদিত কোটি কোটি টাকার পণ্য ভারত ও সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে যায়।
বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার নর্থ বেঙ্গল গোল্ডেল জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুভাষ প্রসাদ কানু জানান, এখানে উৎপাদিত পাটের বিভিন্ন পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়। তবে করোনার পর বিভিন্ন কারণে ব্যবসা খুব ভালো হচ্ছে না।
আবাসন খাত সূর্যোদয়
আয়তনের দিক থেকে বগুড়ায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশের চেয়েও বড়। ৬৯ দশমিক ৫৬ বর্গকিলোমিটারের এই পৌরসভায় পাঁচ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। তিনটি বিভাগীয় শহরের বাহিরে দেশের মধ্যে আবাসন খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বগুড়া। বগুড়ায় আবাসন শিল্প খাতে ব্যবসায়ীরা অন্তত ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে ব্যবসায়ীদের। দেশের আবাসন খাতে গুরুত্বের বিবেচনায় চার নম্বর অবস্থানে এই জেলা। কেন্দ্রীয় অবস্থানের কারণে এক নম্বর স্থানে রয়েছে ঢাকা। পরের অবস্থান বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামের।তৃতীয় স্থানে ব্যবসায়ীকভাবে শক্ত খুঁটি তৈরি করতে পেরেছে সিলেট। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসা শুরুর ২০ বছরের মধ্যে বগুড়া দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরকে পেছনে ফেলে আবাসন খাত উর্দ্ধমুখী গতিতে।
১৯৯৯ সালে বগুড়ার বিখ্যাত ব্যবসায়ী ময়েজ মিয়ার হাত ধরে শুরু হওয়া আবাসান ব্যবসা বেশ বাজার পেয়েছে। এ কারণে প্রতিনিয়ত এখানে বহুতল ভবন গড়ে উঠছে।ভৌগোলিক কারণে বগুড়া রাজশাহী ও উত্তরাঞ্চলের ‘প্রাণ কেন্দ্র’; কৃষি, শিল্প যন্ত্রাংশ নির্মাণ কারখানা ও উৎপাদিত পণ্য দেশের বাহিরে রপ্তানিতে দেশের মধ্যে অন্যতম বগুড়া।এই কারণে এখানে মানুষের বসবাসের চাহিদা ব্যপক।এই বিষয়টি মাথায় রেখেই বগুড়ায় আবাসন ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকে।
দেশের প্রথম সিরামিক কারখানা
প্রায় ৪০ বছর আগে উত্তরের পিছিয়ে পড়া জনপদে সিরামিক কারখানা গড়ে ওঠে বগুড়ার কলোনী এলাকায়। ‘তাজমা সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড তিন একর জমিতে ৫০ জন শ্রমিক নিয়ে যাত্রা শুরু করে ১৯৫৯ সালে। শুধু তৈজসপত্র তৈরির বিশেষায়িত এই কারখানার মাধ্যমে এদেশে আধুনিক সিরামিক শিল্পের যাত্রা হয়।শুরুতে এখানে তিন থেকে চার ধরনের কাপ তৈরি হলেও এখন অন্তত ৭০ রকমের তৈজসপত্র উৎপাদন করা হয়। বগুড়ায় এখন অন্তত চারটি সিরামিক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে শত শত মানুষের।
বগুড়ায় এখন বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল জরুরি দরকার উল্লেখ করে বগুড়া চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাইরুল ইসলাম বলেন, ঐতিহাসিকভাবেই বগুড়া বাণিজ্যিক এলাকা। এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো। অনেক বিনিয়োগকারী তৈরি হয়েছে। এখন বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেললাইন আর বিমানবন্দর চালু হলে এখানে শিল্পায়নের দ্রুত বিস্তার ঘটবে।
কী বলছেন ব্যবসায়ীরা
বগুড়ার বাহিরে উত্তরাঞ্চলে কোনো জেলায় শিল্পায়ন গড়ে না ওঠার পেছনে যোগযোগ সংকট, গ্যাস সরবরাহ না থাকা আর দেশের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কথা বলার মানুষের অভাবকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা।
উত্তরের সমৃদ্ধ জেলা দিনাজপুরে শিল্পকারখানা বলতে গেলে চাউল কর। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্র বলছে, দিনাজপুরে ১ হাজার ২০০ হাস্কিং মিল এবং ২৮০টি অটো রাইস মিল রয়েছে।
ঠাকুরগাঁও চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সদস্য রেজাউল করিম জানান, শিল্পায়ন ঘটাতে গেলে সরকারের বিভিন্ন সহযোগিতা দরকার। কিন্তু উত্তরাঞ্চল প্রায় সময় রাজনৈদিকভাবে অবহেলিত। সরকারি নজর নেই। উত্তরাঞ্চলকে এগিয়ে নিতে হলে আলাদা শিল্পনীতি দরকার। তাহলে দেশ বিদেশের বিভিন্ন মানুষ উত্তরের শিল্পায়নের জন্য বিনিয়োগ করবে।
শুধু কৃষির উপর ভর করে চলা নওগাঁর বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনও (বিসিক) চলতে পারছে না গ্যাস সংকটের কারণে। এখানে ৫৩ টি শিল্প ইউনিটের অধিকাংশ বন্ধ থাকে। যেগুলো চালু রয়েছে সেগুলোতে খাদ্য ও খাদ্যজাত পণ্য, কীটনাশক, ট্রাকের বডি, পাম্পসহ অন্যান্য পণ্য তৈরি হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেনম, চালু থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোও সংকটের মুখে। এ ছাড়া কৃষি প্রধান নওগাঁয় রয়েছে কয়েকশ চাউল কল। সেগুলো চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য জেলার মতো পিছিয়ে রয়েছে রংপুরও। বেড়ম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি ও যোগাযোগ বিশ্লেষক তারিবু রহমান প্রধান বলেন, আগে ঢাকার সাথে এই অঞ্চলের যোগাযোগ অনেক দুর্বল ছিল. এ কারণে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি কঠিন ছিল; সেই সাথে গ্যাস না থাকায় ব্যবসায়ীরা আগ্রহ দেখায়নি এই অঞ্চলে শিল্প কারখানা স্থাপনে। আবার সরকারের সাথে এই অঞ্চলের মানুষে যোগাযোগের ঘাটতি ছিল। সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে এসবের বিকল্প কম।