আমার দেখা আগের কালের ঈদ

ঈদ

আমার দেখা আগের কালের ঈদ

মাজহারউল মান্নান: আমার জন্ম গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের শুরুতে। তখন ব্রিটিশ আমল। পাকিস্তান হয়েছে তারও পাঁচ ছয় বছর পর। সে সময় মানুষের জীবনযাপন ছিলো নিদারুণ কষ্টের। এখনকার লোকজনকে সেটা বিশ্বাস করানোই দায়। খুব অভাব ছিলো ভাত আর কাপড়ের। কোনো কোনো পরিবারে দুই বেলা আহার জোটানো ছিলো খুব কঠিন কাজ। গ্রামে এ ধরনের পরিবারের সংখ্যাই ছিলো অধিক। অবশ্য পরবর্তী অনেক বছর ওই একই অবস্থাই ছিলো। 

ঈদ এলে পরিবারের কর্তা পড়ে যেতেন নিদারুণ চাপে। অতি কষ্টে ছেলেমেয়েদের একটা একটা নতুন জামা কিনে দিতে পারলেও নিজেদের জন্য একটা নতুন লুঙ্গি কিংবা শাড়ি কেনা সম্ভব হতো না। এই অবস্থায় বড়দের ঈদের আনন্দ না থাকলেও বাচ্চাকাচ্চাদের মধ্যে ঈদের আনন্দের কমতি ছিলো না। 

আমি যদি সে সময়ের আমার পরিবারের কথা বলি তাহলে শতকরা নব্বই ভাগ কি তারও অধিক সংখ্যক পরিবারের কথা বলা হবে। শত অভাবের মধ্যেও ঈদের আগের দিন যখন সূর্যাস্তের সময় পশ্চিমাকাশে ক্ষীণকায় চাঁদের দেখা মিলতো, মসজিদ থেকে ভেসে আসতো আযানের ধ্বনি তখন পাড়ার ছেলেমেয়েদের আনন্দচিৎকারে গ্রামের পরিবেশ অন্য রকম হয়ে উঠতো। গরিবের ঘরে ঈদ আসার এ ছিলো এক অন্য রকম আনন্দ। পরদিন ঈদের কথা চিন্তা করে সারা রাত আনন্দে ঘুম আসতো না।  

আমরা কয় ভাইবোন ঈদের দিন খুব সকালে অন্যান্যদের সাথে বাড়ির পাশের নদীতে যেতাম গোসল করতে। ফিরে এসে মায়ের হাতে বানানো সেমাই দিয়ে আখের গুড়ের পায়েস আর তার সাথে চাউল-চিড়া মহা আনন্দে পেট ভরে খেতাম। এমন সুস্বাদু খাবার তো বছরে দুই একবারের বেশি কপালে জুটতো না। হারাখারা ছেলেমেয়েদের এমন আনন্দ করে খাওয়া দেখে মা তার পরনের মলিন শাড়ির আঁচল দিয়ে গোপনে চোখ মুছতেন। 

ঈদের সালামির কথা কেউ তখন চিন্তাও করতো না। সে সামর্থ্যও বেশিরভাগ অভিভাবকের ছিলো না। সামান্য কিছু ধনী পরিবারের মুরব্বিরা তাদের ছেলেমেয়েদের ঈদের সালামি দিতেন। তাও এক আনা, দুই আনা। তার বেশি নয়।

অনেকের মতো বা’জানও লুঙ্গির ওপর ছেঁড়া পুরাতন পাঞ্জাবি আর মথায় একটা মলিন টুপি পরে যেতেন ‘মাঠের নামাজে’। ঈদের নামাজকে বলা হতো ‘মাঠের নামাজ’। কারণ বর্ষা-বৃষ্টি ছাড়া এ নামাজ নির্দিষ্ট একটি মাঠেই অনুষ্ঠিত হতো। এখনকার মতো ঈদগাহ্’র পাকা স্থাপনা কিংবা সুদৃশ্য তোরণ গ্রামের কোনো নামাজের মাঠে দেখা যেত না। অধিকাংশ মানুষের পায়ে জুতা-চপ্পল বলে কিছু ছিলো না। সাধারণত নামাজের মাঠ ছিলো নদী কিংবা পুকুরের ধারে। সেখানে অজু করে মাঠে আসতেন মুসল্লিরা। কেউ কেউ বাড়িতে অজু করে খড়ম পায়ে দিয়ে আসতেন মাঠে। 

সে সময় টুপি সংগ্রহ করাও ছিলো বেশ কষ্টের। এখনকার মতো যত্রতত্র দোকানপাটে রেডিমেড টুপি কিনতে পাওয়া যেত না। কাপড় কিনে দরজিকে দিয়ে বানিয়ে নিতে হতো টুপি। অনেকে টুপি অভাবে গামছা কিংবা রুমাল মাথায় দিয়ে নামাজে দাঁড়াতেন। যাদের সামর্থ্য আছে তাদের অনেকে টুপি বানিয়ে এনে গরিব মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। 

গ্রামের অন্যান্য ছেলেদের মতো আমিও বা’জানের সাথে যেতাম মাঠের নামাজ পড়তে। বাজান তার মাথার মলিন টুপিটা আমার মাথায় পরিয়ে দিয়ে ঘাড়ের গামছাটা মাথায় জড়িয়ে নিতেন। বেশিরভাগ ছেলে (কিছু কম বয়সি মেয়েও থাকতো) নামাজের সময় মাঠের বাইরে খেলাধূলা করতো। আমি বা’জানের পাশে বসে নামাজে শামিল হতাম। বসার একমাত্র ব্যবস্থা ছিলো ‘জুম্মার ঘরে’র চট। এখনকার মতো সুন্দর সুন্দর জায়নামাজ সাথে নিয়ে যাওয়ার সাধ্য প্রায় কারোরই ছিলো না। শুধু ইমাম সাহেব বসতেন একটি জায়নামাজে। সেটা তিনি সাথে করে নিয়ে আসতেন। 

প্রায় মুসল্লি টুপি কিংবা গামছার কোনায় করে নিয়ে আসতেন কয়েক মুঠো চা’ল। ইমাম সাহেবের পাশে বিছানো চাদরে সে চাল ঢেলে দেয়া হতো। চালের সাথে কেউ কেউ চার আনা আট আনা পয়সাও দিতেন। এ থেকেই সাধারণত ইমাম সাহেবের সম্মানী দেয়া হতো। গরিব-দুখীদের হাতেও সামান্য চালের সাথে এক পয়সা দুই পয়সা করে দেয়া হতো। লক্ষণীয় বিষয় সে সময় নামাজিদের বসার সারির ফাকে ফাকে ভিক্ষুকদের হাত পেতে সাহায্য চাওয়ার দৃশ্য সাধারণত চোখে পড়তো না। নির্ধারিত পরিমাণে ফেতরা দেয়ার সক্ষমতা ছিলো খুব সামান্য সংখ্যক মানুষের। দুই একটা ধনাঢ্য পরিবার ছাড়া কেউ গুণেগেথে ফেতরা দিতো বলে মনে পড়ে না।

ইমাম সাহেব আসতেন দূরের কোনো গ্রাম থেকে। আবক্ষ দাড়ি চোগাচাপকানপরা ফর্সা দীর্ঘকায় সুদর্শন এই মানুষটি যখন খোতবা পড়ার জন্য মিম্বরে দাঁড়াতেন আমার মনে হতো যেন একজন স্বর্গের দূত এসে দাঁড়িয়েছেন আমাদের সামনে। তিনি দীর্ঘক্ষণ খোতবা পড়তেন আরবিতে। আরবি ছাড়া মাতৃভাষায়ও যে খোতবা পড়া যায় সে ধারণাই তখন ছিলো না কারও। প্রচÐ রোদের মধ্যে সকলে আরবি ভাষার সে খোতবা শুনতেন গভীর মনোযোগের সাথে। কেউ তার এক বয়ামও বুঝতেন বলে মনে হয় না।

সেই কষ্টের দিনগুলো কবে বাসি হয়ে গেছে এখন আর মনেই পড়ে না। এখন ঈদ আসার অনেক আগেই শুরু হয়ে যায় কেনাকাটা। এখন আর অভিভাবকের দরকার পড়ে না। ছেলেমেয়েরা নিজেই কেনে তাদের পছন্দের পোশাক। এক সেট দুই সেট নয় অনেকে কেনে পাঁচ ছয় সেট। দিনকাল উল্টে গেছে। এখন বাবামায়ের জন্যও পোশাক পছন্দ করে কেনে ছেলেমেয়েরা। লাখ লাখ মানুষ পরিবারের সবার সাথে ঈদ করার জন্য শহর থেকে আসে গ্রামে। ঈদের দিন মোটা অংকের সালামি দেয়া নেয়ার ধুম পড়ে যায়। নানা পদের অঢেল সুস্বাদু খাদ্যখাবারে ভরে থাকে টেবিল। খাবার মানুষই পাওয়া যায় না।

এখন ঈদকে কেন্দ্র করে এতো যে আয়োজন, এতো যে প্রাচুর্য তার অনেকটাই মনে হয় ফাঁকা, মেকি, কৃত্রিম। দুঃখের দিনের সেই ঈদে যে প্রাণের স্পর্শ ছিলো এখন তা আর নেই বললেই চলে। এখন ঈদের সকালে টেবিলভরা মিষ্টি-মিষ্টান্ন ছুঁয়ে দেখতেও মন চায় না। অথচ সেই কষ্টের কালে দুখিনী মায়ের হাতেকরা সামান্য সেমাইয়ের পায়েস আর আখের গুড় দিয়ে মাখা চাউলচিড়ার অমৃতময় স্বাদ এখনও জিহ্বায় লেগে আছে। মায়ের মলিন কাপড়ের মায়াময় স্পর্শ, তার শরীরের সোদাগন্ধ আর কি কখনও পাওয়া যাবে? হায়!
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক।