পেঁয়াজের গুড়া উদ্ভাবন হলেও মিলছেনা সুফল

পেঁয়াজ

পেঁয়াজের গুড়া উদ্ভাবন হলেও মিলছেনা সুফল

আসাফ-উদ-দৌলা নিওন: বাংলাদেশে রান্নায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত উপাদানের একটি পেঁয়াজ। দেশে এই মসলার উৎপাদনও কম নয়। তারপরেও উৎপাদনের একটি অংশ নষ্ট হওয়ার ফলে প্রতিবছর পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। কিন্তু আমদানির খবরে এই মসলার বাজার অনেকখানি এলোমেলো হয়ে যায়। যার ভুক্তভোগী কৃষক-ভোক্তা উভয়ই।

কৃষি বিভাগ সূত্র বলছে, পেঁয়াজের বাজারজাতজনিত ক্ষতি হয় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। এই ক্ষতি পূরণ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে উঠে আসে পেঁয়াজের বহুমুখী ব্যবহারের। যদিও আমাদের দেশে এখনও রান্নায় কাঁচা পেঁয়াজের ব্যবহার হয়ে থাকে।

কিন্তু এর বহুমাত্রিক ব্যবহারের সম্ভাবনা দেখছেন বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্রের এক গবেষক, ড. মাসুদ আলম। কয়েক বছর আগে রান্নায় ব্যবহারের জন্য পেঁয়াজের গুড়া উদ্ভাবনের খবর দিয়ে সাড়া ফেলেছিলেন তিনি। দেশীয় উৎপাদনে নষ্ট হওয়া পেঁয়াজের একটি অংশকে রক্ষা করে ব্যবহারের উপযোগী করার প্রক্রিয়া ছিল তার উদ্ভাবন।

এই উদ্ভাবনটি অবশ্য নানা খবরের ভিড়ে চাপা পড়ে থাকে। তবে পেয়াঁজের বাজারের যেকোনো উত্থান পতনে এই উদ্ভাবনটি আলোচনায় আসে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, মাসুদ আলমের উদ্ভাবনটি পেটেন্ট, শিল্প, ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর থেকে পেটেন্টের অপেক্ষায় দিন গুনছে।

ড. মাসুদ আলমের পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ। পেঁয়াজের সমস্যা দেখে তিনি ২০১৪ সালে গুড়া উদ্ভাবনের দিকে মনোযোগ ফেরান। ২০১৭ সালে এসে সফলতা পান তিনি। পেঁয়াজের গুড়ার উদ্ভাবক মাসুদ আলম জানান, ২০২২ সালের শুরুর দিকে পেটেন্টের আবেদন করেন তিনি। কিন্তু দেড় বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর জানতে পারেন তার আবেদনের প্রক্রিয়াটা ভুল ছিল। ফলে পেটেন্টের আবেদনটি বাতিল হয়ে যায়। পরে পেটেন্ট, শিল্প, ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরে যোগাযোগ করে ওদের নিয়ম ভালোভাবে দেখে ২০২৩ সালের শেষের দিকে আবার আবেদন করেন। এখনও সেটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

পেঁয়াজের উৎপাদনশীলতার প্রয়োজন

পেঁয়াজের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুসারে গত বছরের তুলনায় এবার পেঁয়াজ আবাদ বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। কৃষকদের তরফ থেকেও জানা গেছে, এবার প্রতি কেজি পেঁয়াজ উৎপাদনে খরচ পড়েছে ৫০ টাকার মতো। বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকায়। এরই মধ্যে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে সব শুল্ক তুলে নিচ্ছে। ভারত থেকে পেঁয়াজ রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল। দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আগামী ১ এপ্রিল থেকে শুল্ক প্রত্যাহার কার্যকর হবে।

আবার বিগত ১০ বছরের হিসাব বলছে, বাংলাদেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে অন্তত ২০ লাখ টন। বাংলাদেশের কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, গত বছরে দেশে ৩৪ লাখ ৬০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। এবার পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৬ লাখ টন, যেখানে বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৩০ টন পেঁয়াজ।

তবে সংরক্ষণ, বাছাই করতে গিয়ে এই উৎপাদিত পেঁয়াজের অন্তত ৩০ শতাংশ নষ্ট হয়। যার পরিমাণ প্রায় ১১ লাখ টন। এই ঘাটতি পূরণের জন্যই আমদানি করা হয়। আর  আমদানিতে কোনও সমস্যা দেখা দিলে দাম চড়তে থাকে। এ বিষয়টি কৃষকদের জন্য মোটেও সুখকর নয়। এমন পরিস্থিতিতে পেঁয়াজের উৎপাদনশীলতার প্রসঙ্গ অবধারিত হয়ে ওঠে। কারণ এই কৃষি পন্যের আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থাই বাঁচাতে পারে কৃষকদের। উন্মোচন হবে নতুন অর্থনীতির।

উৎপাদন অর্থ সৃষ্টি করা হলেও অর্থনীতিতে উৎপাদন বলতে কোন বস্তুর রুপান্তর বা পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে তার দ্বারা কোন উপযোগ বা অভাব পূরণের ক্ষমতা সৃষ্টি করাকে বোঝায়। আর উৎপাদনের মাধ্যমে কতটুকু উপযোগ সৃষ্টি করা হলো, তার আনুপাতিক পরিমাণকেই উৎপাদনশীলতা বলে।

এ ছাড়া দেশে আলুর মতো হিমাগারে পেঁয়াজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এখনও পেঁয়াজ সংরক্ষণে সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার হয়। কিন্তু এই পদ্ধতিতে খুব বেশি পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায় না। করলেও একটি বড় অংশ নষ্ট হয়। কিন্তু পেঁয়াজ থেকে রুপান্তরিত পন্য আমাদের চাহিদা ঠিকই পূরণ করবে।

পেঁয়াজ গুড়া উদ্ভাবনের গোঁড়ার কথা

দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের যে ৩০ শতাংশ নষ্ট হয়, সেটিকে ব্যবহারের উপযোগী করতেই ড. মাসুদ আলমের উদ্যোগ শুরু হয়। এবং এ কাজে সফলতাও পান। তার ভাষ্যমতে, কাজটি খুবই সহজ। মানুষ চাইলে নিজের ঘরে বসেও করতে পারে।

মাসুদ আলম জানান, পেঁয়াজের গুড়া সূর্যের তাপে ও যান্ত্রিক পদ্ধতি দুভাবেই করা যায়। এই প্রক্রিয়াজাত কাজে প্রয়োজন পেঁয়াজ কাটার যন্ত্র (স্লাইসার), প্লাস্টিকের পাত্র, লবণ, সোডিয়াম মেটা বাইসালফাইড, ড্রায়ার মেশিন (শুকানোর যন্ত্র), পলিব্যাগ। কয়েকটি ধাপে কাজগুলো শেষ হয়। প্রথমে পেঁয়াজ সংগ্রহ করে বাছাই করতে হয়। বাছাই করা পেঁয়াজ পরিষ্কার করে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে।পরে সেগুলো টুকরা করে কেটে নিয়ে ভাঁপ দিতে হয়। এরপর পেঁয়াজগুলো সোডিয়াম মেটা বাইসালফাইড দ্রবণে ডুবিয়ে রাখতে হবে। পরে ধাপে ধাপে শুকাতে হয়। শুকিয়ে  গেলে  সেগুলো  ব্লেন্ডিং  বা  গুড়া  করলেই  কাজ শেষ। এখন এই গুড়া মোড়কে ভরে সংরক্ষণ করা যায়।

মাসুদ আলম বলেন, যান্ত্রিকভাবে শুকিয়ে করলে সময় লাগবে সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টা। আর প্রাকৃতিকভাবে বাড়তি আর কয়েকদিন সময় লাগবে। দুটো পদ্ধতির খরচ খুব সীমিত। পেঁয়াজকে  গুড়া  করে  ভালোভাবে  সংরক্ষণ করলে তা প্রায় দুই বছর ব্যবহার উপযোগী থাকে বলে জানান তিনি।

“পেঁয়াজ প্রক্রিয়াজাতকরণে গুড়া করলে এর গুণগত মাণ- খাদ্যে ব্যবহারের পরিমাণ, কোনোটাই কমে না।”

এক কেজি পেঁয়াজ শুকিয়ে গুড়া পাওয়া যাবে ১০০-২০০ গ্রাম। পেঁয়াজ রসালো হলে গুড়া পাওয়া যাবে কম। এ ধরনের প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য মসলার ব্যবহার জাপান, চীন, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বহু দেশেই রয়েছে। বাংলাদেশে অন্য সব মশলার গুড়া ব্যবহার হলেও রান্নায় পেঁয়াজের গুড়ার ব্যবহার নেই।

সম্ভাবনা

মাসুদ আলম বলেন, “আমাদের দেশের অধিকাংশ কোম্পানি পণ্য তৈরিতে মসলার গুড়া আমদানি করে। কিন্তু দেশের আবহাওয়ায় কেউ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পেঁয়াজের গুড়া করে না।এ হিসেবে উদ্যোক্তারা দেশে পেঁয়াজের গুড়ার বাজার তৈরি করলে প্রচুর আয় করতে পারবে।” কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারাও মনে করেন  মাসুদ  আলমের  উদ্ভাবন  সংরক্ষণকালে  পেঁয়াজ  নষ্ট  হওয়া  যেমন  রোধ  করবে, তেমনি অর্থনীতির নতুন দিক উন্মোচন হবে।

দেশে বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য যেমন চিপস, আচারসহ অনেক পন্য উৎপাদন করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। এসব পন্য উৎপাদনে পেঁয়াজের গুড়া ঠিকই ব্যবহার হয়। যেগুলো সব আমদানি করে কোম্পানিরা। এই বাজারটা পুরোটাই ধরতে পারে যদি দেশীয় প্রযুক্তিতে পেঁয়াজের গুড়া উদ্ভাবনকে বানিজ্যিকভাবে কাজে লাগানো যায়।

এমন বিষয়টি উল্লেখ করে মাসুদ আলম বলেন, এই উদ্ভাবনকে কাজে লাগিয়ে দেশে উদ্যোক্তা গড়ে তোলা সম্ভব।এখন  গ্রীষ্মকালীন  অনেক  উচ্চফলনশীল  জাত  হয়েছে,  সেগুলো  গুড়া  করে  বাজারজাত  করতে পারবে উদ্যোক্তারা।  পেটেন্ট পেলে উদ্ভাবনকারী গবেষণাটির পূর্ণ স্বীকৃতি পাবেন। কিন্তু এটি সম্পন্ন না হওয়ায় উদ্ভাবনের পূর্ণ স্বাদ থেকে এখনও বঞ্চিত রয়েছেন মাসুদ আলম। দেশও প্রকৃত সুবিধা পাচ্ছে না।

বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের আরেক বিজ্ঞানী ড. নুর আলম চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ নিয়ে কাজ করছেন। তিনিও জানান, মাসুদ আলমের উদ্ভাবন বড় কোম্পানি থেকে শুরু করে তরুণ উদ্যোক্তারা কাজ করতে পারেন। শীতকালীন ছাড়াও দেশে এখন প্রচুর পরিমাণে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদন হচ্ছে। কৃষকরা চাইলে ভোক্তার কাছে পেঁয়াজ বিক্রি ছাড়াও এই গুড়া উৎপাদন করতে পারেন। এতে সংরক্ষণ সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগতে হবে না কৃষকদের। পাশাপাশি পেঁয়াজের বাজারের ডাইমেনশন আসবে। ফলাফল স্বরুপ বলা যায় দেশে কৃষি এই পন্যের অর্থনীতি বড় হবে।

শুধু তাই নয়, মাসুদ আলমের দাবি, একই পদ্ধতিতে রসুন, আদার গুড়াও করা সম্ভব। এসব ক্ষেত্রে বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে সমঝোতা স্মারক চুক্তি (এমওইউ) করে বড় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি পর্যায়ে এই উদ্ভাবনকে বানিজ্যিক রূপ দিতে পারবেন উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি তাদের প্রশিক্ষণের বিষয়টিও মসলা গবেষণা কেন্দ্র দেখবে বলে জানান এই পেঁয়াজের গুড়া উদ্ভাবনকারী।