আলো ছড়াচ্ছে কৃষি হাসপাতাল ও পাঠাগার

আলো ছড়াচ্ছে কৃষি হাসপাতাল ও পাঠাগার

কায়সার রহমান রোমেল: কৃষি ফসলের রোগ নির্ণয় ও তার প্রতিকার সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান, কৃষকদেরকে আধুনিক কৃষি পদ্ধতি এবং প্রযুক্তি সম্পর্কে অবহিত করা, রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার রোধ করে জৈব সার ও উন্নত সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে টেকসই কৃষি গড়ে তোলা এবং কৃষকদের দোরগোড়ায় গিয়ে কৃষি সেবা পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে উত্তরের জেলা গাইবান্ধায় যাত্রা শুরু করেছে কৃষি হাসপাতাল। ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ নিয়েছেন তরুণ এক কৃষি উদ্যোক্তা।

কৃষি হাসপাতালের পাশাপাশি তিনি গড়ে তুলেছেন একটি কৃষি পাঠাগারও। যা কৃষকদের জ্ঞান এবং তথ্যের উৎস হিসেবে কাজ করে। যেখানে কৃষিকাজ সম্পর্কিত বই, জার্নাল, প্রতিবেদন এবং অন্যান্য শিক্ষামূলক উপকরণ সংগ্রহ করা হয়। কৃষকদের আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি এবং চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করা, কৃষি সম্পর্কিত গবেষণার ফলাফল এবং তথ্য কৃষকদের কাছে সহজলভ্য করা, কৃষকদের মধ্যে জ্ঞান আদান-প্রদান এবং পারস্পরিক সহযোগিতার সুযোগ তৈরি করা, কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান এবং উদ্ভাবনী ধারণা সম্পর্কে কৃষকদের অবহিত করার পাশাপাশি কৃষি সম্পর্কিত জ্ঞান ও তথ্য সংরক্ষণ করাই এই কৃষি পাঠাগারের উদ্দেশ্য বলে জানিয়েছেন এর উদ্যোক্তা। 

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গার তরুণ উদ্যোক্তা মো. মহিদুল ইসলাম গড়ে তুলেছেন এই কৃষি হাসপাতাল ও পাঠাগার। জেলা শহর থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার উত্তরে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের রামধন গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মহিদুল বসতবাড়ির ৫২ শতক জায়গায় গড়ে তুলেছেন পারিবারিক পুষ্টি বাগান। তার বাগানে রয়েছে- স্কোয়াশ, ক্যাপসিকাম, বেগুন, টমেটো, শিম, লাউ, গাজরসহ ২৮ প্রকারের সবজি। রয়েছে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মরিচ, তেজপাতা, আলুবোখারা, চুইঝালসহ ১০ থেকে ১২ প্রকারের মসলা জাতীয় গাছ, ১২ প্রকারের ক্যাকটাস ও তিন শতাধিক শোভাবর্ধনকারী গাছ। আরও আছে- স্ট্রবেরি, থাই আমড়া, মিষ্টি তেঁতুল, কদবেল, নারকেল, ১০ প্রকারের আমসহ অর্ধশতাধিক ফলজ এবং গর্জন, মেহগনি, গামারি, লম্বুসহ ১৫ থেকে ১৬ প্রকারের বনজ গাছ। এছাড়াও আখ এবং বেশ কয়েক প্রকারের ঔষধি ও বনসাঁই রয়েছে মহিদুলের বাগানে। রয়েছে জৈব সার উৎপাদনের জন্য ভার্মি কম্পোস্ট প্রকল্প। বাড়ির পাশের পুকুরে চাষ করছেন টেংরা, পুটি, মোয়া, শিং, কইসহ নানা রকম দেশি মাছ। 

ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রথমে বড় ভাই পরে বাবার মৃত্যুর পর মহিদুল ভীষণ একা হয়ে যান। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে তিনি বাগান তৈরি ও পরিচর্যায় মনোযোগী হন। ২০১৭ সালে দেড় শতক জমি বিক্রির ৭০ হাজার টাকা দিয়ে নিজ বাড়িতে এই কৃষি প্রকল্পটি গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। এ প্রকল্প থেকে বর্তমানে তার মাসিক আয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। এ কাজে তার সহযোগী হিসেবে আছেন স্ত্রী ফারজানা ববি রজনি আর একমাত্র পুত্র ফারহান মুহিব নিহাল। বাগানের একপাশে বসতবাড়ির আঙিনায় রয়েছে নারকেল পাতা আর ছনের ছাউনি দেওয়া বাঁশের তৈরি একচালা ঘর। এই ঘরেই চলে মহিদুলের কৃষি হাসপাতাল ও পাঠাগার কার্যক্রম।

বিনামূল্যে কৃষি প্রযুক্তি ও চাষ বিষয়ক প্রয়োজনীয় তথ্য এবং জ্ঞান সহজে পেতে কৃষকরা এখানকার কৃষি পাঠাগার থেকে চাইলেই একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিতে পারেন বই, আবার নির্দিষ্ট সময়ের পর ফেরত দিয়ে নিতে পারেন অন্য বই। কৃষি সম্পর্কিত সমস্যাগুলির সমাধান খুঁজে পেতে এখানে ভিড় জমায় নানান বয়সী কৃষক, অনেকে এখানে বসেই বই পড়েন আবার অনেকে বই নিয়ে যান নিজের বাড়িতে। এছাড়া কৃষি হাসপাতাল থেকে কৃষকরা তাদের ফসলের যেকোনো সমস্যায় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে পারেন। এখানকার পরামর্শ কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং উন্নত চাষ পদ্ধতি ও উ্ৎপাদশীলতা বাড়াতে সহায়তা করছে। এতে কৃষকদের সময় এবং অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে।

মহিদুলের কৃষি হাসপাতাল ও পাঠাগার এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বিভিন্ন ফসলের রোগ শনাক্ত এবং রোগের কারণ নির্ণয় করতে স্থানীয় চাষিরা কৃষি হাসপাতালে আসছেন। এছাড়া কৃষি পাঠাগার কৃষকদের জন্য বিভিন্ন কৃষি সম্পর্কিত বই, জার্নাল এবং অন্যান্য তথ্য সরবরাহ করায় এর মাধ্যমে কৃষকরা তাদের জ্ঞান এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারছেন। মহিদুলের এমন উদ্যোগ নজর কেড়েছে কৃষি বিভাগের কর্তাদেরও। স¤প্রতি কৃষি হাসপাতাল ও পাঠাগার কার্যক্রম পরিদর্শনে এসেছিলেন কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি গাইবান্ধা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরকে কৃষি হাসপাতাল ও পাঠাগার কার্যক্রমের একটি ডকুমেন্টারি তৈরির নির্দেশ দেন।

উদ্যোক্তা মহিদুল ইসলাম জানালেন, কৃষি হাসপাতাল একটি বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র যা উদ্ভিদ ও কৃষি ফসলের রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধে নিবেদিত। এটি মানুষের হাসপাতালের মতো, তবে এখানে রোগী হলো ফসল, গাছপালা এবং অন্যান্য কৃষি পণ্য। আর কৃষি পাঠাগার হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে কৃষিকাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য, জ্ঞান ও উপকরণ সংগ্রহ করে রাখা হয় এবং কৃষকদের জন্য ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হয়। এটি কৃষকদের কৃষিকাজ সম্পর্কে জ্ঞান বাড়াতে, নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে। এ পর্যন্ত কৃষি হাসপাতালের সেবা নিয়েছেন শতাধিক কৃষক। এছাড়া কৃষি পাঠাগারে প্রতিদিন পাঠক উপস্থিতি ২০ থেকে ২৫ জন।

তিনি বলেন, বাবা আবদুল ওয়াহেদ বন বিভাগে চাকুরি করতেন। বাবার কারণেই ছেলেবেলা থেকেই গাছ-গাছালির প্রতি তার আকর্ষণ তৈরি হয়। এখান ওখান থেকে বিভিন্ন ফসলের ভালো জাত সংগ্রহ করে তার আঙিনা ও মাঠে লাগাতেন। ভালো জাতের ফলের চারা সংগ্রহ ও কলম করে রাখতেন বাড়িতে। সেগুলো যদি ভালো ফলন দিত তবে তিনি সেই জাতের বীজ বাড়িয়ে আশপাশের কৃষকদের মাঝে বিতরণ করতেন। সুযোগ পেলেই তিনি কৃষি বিষয়ক বই জোগাড় করে মন দিয়ে পড়তেন। যতটুকু সম্ভব কৃষকদের কৃষি বিষয়ক তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করার চেষ্টা করতেন। এটাই তার ভালো লাগা, ভালোবাসা। এভাবেই তিনি শুরু করেন কৃষিসেবার কাজ। ২০১৭ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন কৃষি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম থেকে বই, লিফলেট, পোস্টার সংগ্রহ করতে শুরু করেন। ক্রমে ক্রমে তার কৃষি ও মৎস্য এবং পশুসম্পদসহ বিভিন্ন বিষয়ে বইয়ের একটা মজুদ তৈরি হয়। তথ্যনির্ভর এসব বই একসঙ্গে কোথাও পাওয়া যায় না। এজন্য পাঠাগার করার কথা ভাবেন। লক্ষ্য, কৃষকদের কৃষি বিষয়ক তথ্য জানানো ও বিজ্ঞানসম্মত চাষবাসে সহযোগিতা করা। গত তিন বছর ধরে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিয়ে স¤প্রতি তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কৃষি হাসপাতাল ও পাঠাগার কার্যক্রমের যাত্রা শুরু করেছেন।

মহিদুল নিজেই এ কৃষি হাসপাতাল ও পাঠাগার দেখভাল করেন। প্রতিদিন এটি খোলা থাকে। পাঠাগারে ভর্তি হতে হয় না। মাসিক চাঁদাও দিতে হয় না। পাঠাগারের ভেতর চেয়ার, চৌকি ও মোড়ায় বাসে দিনভর বই পড়া যায়। যারা পড়তে জানেন না, তারা পরিচিত কাউকে দিয়ে পড়িয়ে তা শোনেন। পাঠক কৃষক-কৃষানীদের নিয়ে তিনি নিয়মিত পাঠচক্রের আয়োজন করেন। এছাড়া ফসলের যেকোনো সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে তিনি গাইবান্ধা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর, গাইবান্ধা কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, সুন্দরগঞ্জ কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ স্থানীয় কৃষিবিদদের পরামর্শ নিয়ে কৃষি হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

কৃষিবিদরা মহিদুলের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ প্রসঙ্গে বলছেন, কৃষি হাসপাতাল ফসলের রোগ ও কীটপতঙ্গ থেকে রক্ষা করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত, সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশ সুরক্ষায় অবদান রাখতে পারে। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হওয়ায় কৃষি হাসপাতাল গুরুত্বপ‚র্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য কৃষি হাসপাতালের ভ‚মিকা আরও গুরুত্বপ‚র্ণ হয়ে উঠবে। উন্নত প্রযুক্তি এবং গবেষণার মাধ্যমে এই কৃষি হাসপাতাল ধারণাটি আরও কার্যকর এবং কৃষকদের জন্য আরও ভালো সেবা প্রদান করতে পারে। এছাড়া কৃষি পাঠাগার স্থাপনের মাধ্যমে কৃষকদের আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক এবং কৃষি যন্ত্রপাতি সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান করা সম্ভব। এটি কৃষকদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে, কৃষিকাজে সম্মুখীন হওয়া বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সাহায্য করবে।

গাইবান্ধা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. খোরশেদ আলম জানান, তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা মহিদুল ইসলামের ‘কৃষি হাসপাতাল ও পাঠাগার’ উদ্ভাবনী ধারণাটি কৃষি বিভাগের নজরে এসেছে। এই উদ্যোগটি এখনও প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায় থেকে এই উদ্ভাবনী উদ্যোগকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ এবং সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী